স্বপ্নীল হকঃ
কথিত নব্য জেএমবি সদস্যের তকমা লাগিয়ে পুলিশের দায়েরকৃত মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে খুলনা জেলা কারাগারে বন্দি রয়েছে খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী। তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় ৪টি মামলা। এর মধ্যে একটি মামলায় ২০ বছর এবং অন্য একটি মামলায় ১০ বছর সাজা প্রদান করেন আদালত। আরও দু’টি মামলা বিচারাধীন। আগামী ২৭ নভেম্বর বিচারাধীন মামলার হাজিরার দিন ধার্য রয়েছে।
এদিকে স্বৈরাচার সরকার পতনের পর সাজাপ্রাপ্ত দু’জনেই মুক্তির দাবিতে অনশন করছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর থেকে প্রথমবার তারা অনশন শুরু করেন। পরে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করলে তারা অনশন প্রত্যাহার করে। কিন্তু অদ্যাবধি মুক্তি না মেলায় ফের তারা গত ১০ নভেম্বর থেকে পুনরায় অনশন শুরু করে। এর মধ্যে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে মোজাহিদুল অনশন ভঙ্গ করলেও অনিক অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন। তার শরীরের অবস্থা এখন সঙ্কটাপন্ন বলে জানিয়েছেন তাদের আইনজীবী আক্তার জাহান রুকু।
তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, দ্রুত অনিককে খুলনার ভাল মানের কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা না করালে তাকে বাঁচানো সম্ভব না-ও হতে পারে। তিনি জানান, অনিকের আইনজীবী হিসেবে তাকে আমি বুঝানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু তার সাফ কথা ‘হয় মুক্তি, নয় লাশ হয়ে কারাগার থেকে বের হবো’। এমতাবস্থায় খুলনা জেলা কারাগারের সুপার মোঃ নাসির উদ্দিন প্রধান গত ১৩ নভেম্বর বিষয়টির সদয় অবগতির জন্য খুলনার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে একটি পত্র দিয়েছেন।
উলেখ্য ২০২০ সালে নুর মোহাম্মদ অনিক ওরফে নূর (২৪) খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ও মোঃ মোজাহিদুল ইসলাম পরিসংখ্যান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। অনিক মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর থানার মোড়াবাড়ি গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে আর মোজাহিদুল ইসলাম বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ থানার ঘাগুর দুয়ার গ্রামের রেজাউল করিমের ছেলে।
জেল সুপারের চিঠি আদালতে : খুলনার জেল সুপার মোঃ নাসির উদ্দিন মহানগর দায়রা জজ বরাবর পত্রে জানান, বরাতোক্ত স্বাক্ষরের প্রেক্ষিতে আদালতের সদয় অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, বিষয়োক্ত বন্দিদ্বয়কে ২০২০ সালে ২২ অক্টোবর আদালতের মাধ্যমে অত্র কারাগারে প্রেরিত হয়। পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে নগরীর সোনাডাঙ্গা থানায় দায়েকৃত বিস্ফোরক মামলায় বিজ্ঞ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত কর্তৃক ২০২২ সালের ২২ মে ২০ বছর সশ্রম কারাদন্ড ও এক লক্ষ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ৬ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। এছাড়া সোনাডাঙ্গা থানার সন্ত্রাস বিরোধী আইনে দায়েরকৃত মামলায় সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক ১০ বছর সাজা ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে এক বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
খুলনা জেলা কারাগারের সুপার পত্রে আরও উলেখ করেন, ৫ আগস্ট ২০২৪ এর পরিবর্তিত পরিস্থিতির পর গত ২২ সেপ্টেম্বর উক্ত বন্দিদ্বয় কর্তৃপক্ষের নিকট জানান যে, তারা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪র্থ বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন ২০২০ সালে ৮ জানুয়ারি পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। এরপর দীর্ঘ ১৭ দিন বগুড়া ডিবি হেফাজতে নিয়ে গুম করে নির্যাতনের পর তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা বানোয়াট মামলা দেয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিগত শেখ হাসিনা সরকারের দেশের স্বার্থবিরোধী কর্মকান্ডের কট্টর সমালোচনা করে জনমত গড়ে তোলার কারণে তারা প্রহসনের মামলার শিকার হয়েছেন। বিগত ছাত্র জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও তারা কারাগারে এখনও আটক থাকায় বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এবং সাজাভোগ করছেন। তাদের বর্তমান সরকারের সাথে যোগাযোগ পূর্বক কারাগার থেকে দ্রুত মুক্তির ব্যবস্থা না করায় কারাগারে গত ২২ সেপ্টেম্বর ১ম বার অনশনের হুমকি দিয়ে সরকারি খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। ঐ সময়ে তাদের আগ্রহ অনুযায়ী খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়কের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করিয়ে তাদেরকে স্বাভাবিক করানো হয়। কারাগার থেকে এখনও মুক্তি না পাওয়ায় তারা একই দাবি তুলে গত ১০ নভেম্বর হতে পুনরায় সরকারি খাবার গ্রহণ করা হতে বিরত রয়েছেন।
কারাবিধি অনুযায়ী নিয়মিত খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে, কারা হাসপাতালের সহকারী সার্জনের মাধ্যমে তাদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণে রাখা হচ্ছে, নিয়মিত কাউন্সিলিং করা হচ্ছে এবং গত ১২ নভেম্বর ও গত ১৩ নভেম্বর তাদের দাবির প্রেক্ষিতে বিশেষ বিবেচনায় তার আইনজীবী ও আত্মীয় স্বজনের সাথে সরকারি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কথা বলানো হয়েছে। কিন্তু তন্মধ্যে একজন কয়েদি নং-২০৬৯/এ, নুর মোহাম্মদ অনিক এখনো অনশনরত আছেন। সংশ্লিষ্ট বন্দীদ্বয়ের কারাগারে আচার-আচরণের বিষয়টি বিজ্ঞ আদালতের সদয় জ্ঞাতার্থে অবহিত করা হলো।
উলেখ্য, উক্ত শিক্ষার্থীদের দেয়া তথ্য মতে বিগত ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি আটক করার ১৭ দিন পরে ২৫ জানুয়ারি তাদের গ্রেফতার দেখানো হয় এবং তৎকালীন খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার খন্দকার লুৎফুল কবির গণমাধ্যমে প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে সেটি নিশ্চিত করেন। সেসময় পুলিশ কমিশনার ও সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ওই দু’জন নব্য জেএমবির সদস্য। তাদের কাছ থেকে বোমা তৈরির বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। স¤প্রতি খুলনা নগরের খানজাহান আলী থানা কৃষক লীগ কার্যালয় ও আড়ংঘাটা থানার সামনে বোমা হামলার ঘটনার সঙ্গে ওই দুজন জড়িত ছিলেন। বোমা তৈরির উপকরণ তারা স্থানীয় ভাবে সংগ্রহ করতেন।
ওই সময় কেএমপি কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে কেএমপি কমিশনার খন্দকার লুৎফুল কবির বলেন, গত বছরের (২০১৯ সাল) ২৩ সেপ্টেম্বর খানজাহান আলী থানা কৃষক লীগ কার্যালয় ও ৫ ডিসেম্বর (২০১৯ সাল) আড়ংঘাটা থানার গাড়ি রাখার গ্যারেজে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। নুর ও মুজাহিদুল প্রাথমিকভাবে ওই ঘটনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তারা নব্য জেএমবি সদস্য।
কমিশনার লুৎফুল কবির ওই সময় আরও বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা উগ্রবাদী মতাদর্শে আকৃষ্ট হন। পরে নব্য জেএমবিতে সম্পৃক্ত হন। একপর্যায়ে নিজেরাই নাশকতামূলক কর্মকান্ড পরিচালনার ছক তৈরি করেন এবং দূরনিয়ন্ত্রিত বোমা তৈরির কারিগরি জ্ঞান অর্জন করেন। তারা দূরনিয়ন্ত্রিত বোমা প্রস্তুত করে ওই দুই স্থানে বিস্ফোরণ ঘটান। বোমার সরঞ্জামাদি রাখার জন্য তারা ভাড়া বাসা ব্যবহার করতেন।